প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎ

যখন প্রচন্ড কাজে ডুবে থাকি, নিশ্বাস নেওয়ার উপায় থাকে না, খাবি খাওয়ার মতো হাঁসফাঁস করি তখন অবচেতন মনেই ঠাওর হয় দু-একদিন ধরে বোধহয় বই পড়া হচ্ছে না। বেঁচে থাকতে হলে শরীরের জন্য যেমন অক্সিজেন লাগে তেমনি মনকে বাঁচাতে হলেও বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। অন্তত আমার কাছে তো তাই মনে হয়। শরীর ও মনের অদৃশ্য মেলবন্ধনের নাম বই। মেলবন্ধন আমাদের যাপিত জীবনের, সময়ের। তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো‘।

এ বছর আমরা এক অভূতপূর্ব বইমেলার সাক্ষী। ৩৭তম অমর একুশে বইমেলা, যাকে করোনা ফেব্রম্নয়ারিতে শুরু হতে দেয়নি এর চিরায়ত নিয়মে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুলস্নাহ সিরাজী বললেন, ১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে বইমেলা শুরু হচ্ছে না। নিউজটা দেখার পর থেকেই কোনো এক অশনি সংকেত টের পাচ্ছিলাম। আহা প্রাণের বইমেলা! আর দুই-চারটা উৎসব পার্বণের চেয়ে বইপ্রেমীদের কাছে এ মেলার গুরুত্ব ঢের বেশি। আমার মতো পাঠকরা এ মেলার জন্য সারাবছর মুখিয়ে থাকে যার গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মনজুরে মওলার হাত ধরে।

অবশেষে মেলা হওয়া না হওয়ার দোলাচলে দুলতে দুলতে মার্চের ১৮ তারিখে গিয়ে গড়ায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন মেলার। হিসাব-নিকাশ কষে ঘোষণা করা হয় মেলা চলবে ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের দিন পর্যন্ত। কিন্তু দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কাও বাড়তে থাকে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের কারণে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১২ এপ্রিল বন্ধ করে দিতে হয়েছে বইমেলা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এত কিছু উপেক্ষা করেও করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ছোটরা, বড়রা, বুড়োরা বইমেলায় এসেছেন। বই কিনেছেন। বইয়ের প্রতি তাদের আবেগ অনুভূতির কথা জানিয়েছেন।

কতশত নাটকীয়তা যে ছিল বইমেলাকে ঘিরে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। একে তো শুরু হবে হবে করেও শুরু হচ্ছিল না বইমেলা। আবার যখন শুরু হলো দু-একদিন পরপর সকাল-বিকাল মেলার সময় পরিবর্তনের মহড়া। তার উপর কঠোর লকডাউন। নগরবাসীকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ কিন্তু মেলা চলবে বহাল তবিয়তে। কি আচানক কান্ড! কোনো কোনো প্রকাশক মনঃকষ্টে বইপত্র, দোকান গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। কেউ কেউ ফেসবুকে ‘আলস্নাহ্‌?র নামে চলিলাম’ স্ট্যাটাস দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। তবু মানুষ মেলায় গিয়েছে। বই কিনেছে। আমি আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হই না খুব একটা। তবুও আবেগতাড়িত হলাম মানুষের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে। আহা, নতুন বই! মুখ গুঁজে শুষে নেওয়া নতুন কাগজের ঘ্রাণে কি এক অনুপম অনুভূতি!

শুধু যে দেশি লোকজনই মেলায় এসেছে ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। বিভিন্ন মিডিয়া কাভারেজে আমরা বিদেশিদেরও দেখেছি। অনেকে শাড়ি, চুড়ি পরে বঙ্গ ললনা সেজে মেলায় এসেছেন। সুনীল, সুকান্ত তারা বোঝেন না। কিন্তু পরম মমতায় উল্টে-পাল্টে দেখেছেন। বই কিনে ব্যাগে ভরেছেন। এ সব দেখে মন দ্রবীভূত হয়। উদ্বেলিত হয়। এবারের বইমেলা ৫৪০টি স্টল অংশ নিয়েছে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তৃত জায়গাজুড়ে। সর্বমোট নতুন বই এসেছে ২৬৪০টি। আয়োজক কমিটি মেলার ডিজাইন করেছিল স্বাস্থ্যবিধির কথা মাথায় রেখেই। ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি। তবে এতকিছুর পরেও নিয়মের ব্যত্যয় যে ঘটেনি তা কিন্তু নয়।

আবার একদল বোদ্ধা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরগরম ছিল মেলা বন্ধ নিয়ে। জ্বালাময়ী লেখা লিখে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ‘করোনা কি বইমেলায় যায় না? এই মূর্খের দেশে এত জ্ঞানী এতদিন কোথায় ছিল’? এ সব কথাবার্তা। এতে কে কান দিয়েছেন বা দেননি সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিষয় হলো প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কথা আমরা ঘুণাক্ষরেও ভাবী না কিন্তু সরকার ভাবুক সেটা আমরা চাই। অন্যান্য বছরের একদিনের বই বিক্রির সমানও সারা মাসে বিক্রি করতে পারেনি অনেক প্রকাশনী। তাহলে এই মানুষের কি হবে? তারা কি খাবে না? তাদের কি সংসার নেই? তারা কি অচ্ছুৎ? এতসব প্রশ্নের সামনে আমজনতা দাঁড়াবে না আবার সরকারও চায় পিঠ বাঁচিয়ে চলতে। বস্তুতই মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রকাশনা শিল্প। প্রকাশকদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১০০ কোটি টাকা বই ক্রয়ের অনুরোধ জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে যে আশা করেছিল প্রকাশনা শিল্প তা কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যারাও টিকে আছে নূ্যনতম লোকবল নিয়ে কতদিন এভাবে টিকে থাকবে তা নিশ্চয়ই আতঙ্কের খবর। করোনা হয়তো আমাদের নাও ছেড়ে যেতে পারে। তবু জীবন চলবে, চালাতে হবে যে কোনো উপায়ে, যে কোনো সমীকরণে। কারণ জীবন এমনই। এমন অবস্থায় প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ অতীব জরুরি। একটি জাতি মেধা, মননে ও সৃজনশীলতায় বেড়ে উঠতে চাইলে বই পড়া ও বইয়ের সঙ্গে গড়ে ওঠা শিল্পকে দেখভাল করার কোনো বিকল্প নেই, খাটো করে দেখার কোনো সুযোগও নেই। আমরা চাই অতিমারি-অন্তে সুদিন আসুক। শঙ্কামুক্ত দিনে আবার বইমেলা হোক। লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মিলনমেলায় আবার মুখরিত হোক বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। নিদেনপক্ষে একজন পাঠকের জন্য এর চেয়ে বেশি চাওয়ার আর কি বা থাকতে পারে।

 এম মিরাজ হোসাইন, লেখক, গবেষক

তথ্যসূত্রঃ যায়যায়দিন
অন্যান্য সংবাদঃ বান কি মুন দুই বছর আগের দেওয়া কথা রাখলেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *