একুশে বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বাধিকার অর্জনের চেতনা, আত্মত্যাগের ইতিহাস। বইমেলা সারাদেশের মানুষের সামাজিক সম্মিলনের চেতনাকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে। এবারের বইমেলায় নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে বিশিষ্ট কথাশিল্পী, লেখক এম মিরাজ হোসেনের ‘আজব বাংলাদেশ’ ও ‘চিঠির আঁধারে’ নামক দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইমেলা, নিজের লেখালেখি, ভাষা ও সাহিত্যের নানাদিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বীরেন মুখার্জী
যাযাদিঃ জুলাই আন্দোলন পরবর্তী প্রথম বইমেলা কেমন লাগছে?
এম মিরাজ হোসেন: বইমেলা সব সময়ের জন্যই ভালো লাগে। এটা বাঙালির প্রাণের উৎসব। ভাষার জন্য যেমন এ জাতি অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, তেমনি আমাদের বইমেলার মতো মাসব্যাপী বইমেলা বিশ্বের আর কোনো দেশেই নেই। সেই অর্থে আমাদের বইমেলা স্বতন্ত্র। এখন পর্যন্ত মেলায় বেচাকেনাও ভালো দেখছি। শেষ দিকে এসেও পাঠকের কমতি নেই। মেলার পরিসর এবং স্টলের সংখ্যাও বেড়েছে এবার। সব মিলিয়ে ভালো সময় পার করছি।
যাযাদি: আপনার লেখালেখি সম্পর্কে জানতে চাই।
এম মিরাজ হোসেন: আমি ভ্রমণ সাহিত্য নিয়ে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেছি। একাধারে গল্প-উপন্যাস-ভ্রমণগদ্য লিখছি। আমার লেখা সব বয়সি পাঠকের জন্যই। সাবলীল-সহজ শব্দে আমি লেখালেখি করি। আমার লেখাগুলো সবারই ভালো লাগে। তার প্রমাণ হচ্ছে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত আমার একটি ভ্রমণবিষয়ক বই এবং একটি উপন্যাসের পঞ্চম সংস্করণ চলছে। আশা করি, আরেকটি সংস্করণও এ মেলায় আসতে পারে।
যাযাদি: রাজনৈতিক আলোচনা নয়, তবুও এবারের বইমেলায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি পোস্টার সবার নজর কেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। আপনিও নিশ্চয়ই এটি দেখে থাকবেন। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
এম মিরাজ হোসেন: বিষয়টি আমি দেখেছি। অন্য সবাইও দেখেছে। আসলে ‘৫২-এর চেতনা, ‘২৪-এর প্রেরণা কথাটি যুক্তিযুক্ত হলেও মাঝখানে কিন্তু ‘৭১ অনুপস্থিত। বোধ করি, এ বিষয়টিই আপনি বলতে চাইছেন। আমি অন্যসব লেখালেখির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও কাজ করি। এই বাস্তবতায় বলতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের অনুপস্থিতির বিষয়টি নিঃসন্দেহে পীড়াদায়ক। আমাদের যেমন ভাষা আন্দোলন আছে, তেমনি আছে মুক্তিযুদ্ধ। আছে উনসত্তর, আছে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধকে কিছুতেই পাশ কাটানো যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, আপামর জনগণের। মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিলে আমরা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ব। এটা হয়ত কোনো কারণে মিসিং হয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেশে এক ধরনের আমলাতান্ত্রিকতা দেখে অভ্যস্ত। এর পেছনে কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর ইন্ধন আছে কিনা, সে বিষয়টিও প্রশ্নসাপেক্ষ। সুতরাং, আমরা কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চর্চা না করি। শুধু বলি এটা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কারণ, ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাসে যার যার স্থান নির্ধারিত। এটাকে অস্বীকার করা মানেই বোকামি। এবারের বইমেলায় বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে- যা মিডিয়ার কল্যাণে সবাই জানে। আসলে বইমেলার মতো একটি সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের মিলনমেলায় এমন ঘটনা শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, দুঃখেরও। তবে, নির্বাচিত সরকার এলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদী।
যাযাদি: আপনি বলছেন, আপনার লেখা সব ধরনের পাঠকের জন্য। আমি জানতে চাই, শিশুদের নিয়ে পৃথকভাবে কিছু কাজ করার ইচ্ছা আছে কিনা?
এম মিরাজ হোসেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, সহজ কথা যায় না বলা সহজে। কথাটি শিশুসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বেশি করে মনে রাখা দরকার। অন্য সবার মতো আমিও মনে করি, শিশুসাহিত্য রচনা অত্যন্ত কঠিন। যারা শিশুসাহিত্য রচনা করেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, শিশুদের নিয়ে কাজ করতে হলে তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। একেবারে তাদের মতো করেই লিখতে হবে। আমাকে প্রায়ই বিভিন্নজন প্রশ্ন করেন, আমি কেন কবিতা লিখছি না। আসলে কবিতা আমিও লিখি; তবে, সেটা প্রকাশ হচ্ছে না। গদ্যসাহিত্যে সবকিছু সহজে তুলে ধরা যায়, এজন্য আগে গদ্যসাহিত্য নিয়েই কাজ করছি। কবিতা এবং শিশুদের জন্য কাজ করছি। আগামীতে এর প্রতিফলন পাঠক দেখতে পাবে।
যাযাদি: অতিপ্রাকৃত ঘটনার ওপর আপনার একটি বই আছে ‘ব্যাখ্যাতীত’; এই বইয়ের বিষয়ে কিছু বলুন এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনা নিয়ে আপনার নিজস্ব বিশ্বাসই বা কি?
এম মিরাজ হোসেন: গত বছরের (২০২৪) বইমেলায় নওরোজ কিতাবিস্তান থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল ‘ব্যাখ্যাতীত‘। বইমেলায় দ্বিতীয় সংস্করণও বেরিয়েছিল। বইয়ে ৮টি গল্প আছে। আসলে কোনো না কোনো সময় ওই ঘটনাগুলো আমার সঙ্গে ঘটেছে। সেগুলোই আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। গল্পগুলো পাঠের পর অনেকেই জানতে চেয়েছেন আমি কুসংস্কারে বিশ্বাস করি কিনা? কিন্তু ব্যাপারটি তেমন নয়। আমি মোটেও কুসংস্কার আমদানি করছি না। জীবনে, চলার পথে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। আমার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও অতিরঞ্জিত নয়। আমি বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছি। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে গিয়ে নতুন নতুন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। আসলে কিছু কিছু বিষয় থাকে যা কখনো ব্যাখ্যা করা যায় না। সেগুলোই ‘ব্যাখ্যাতীত’।
যাযাদি: বইমেলা ও বাঙালি পাঠক সমাজ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
এম মিরাজ হোসেন: বইমেলাকে জ্ঞানচর্চার সূতিকাগার বলে মনে করি। বইমেলা এ জাতির জ্ঞানচর্চার চেতনার পথপ্রদর্শক। যে জাতি জ্ঞানচর্চায় যত অগ্রবর্তী, সেই জাতি বা সেই জনগোষ্ঠী পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবে, গড়ে তুলবে। ইতিবাচক একটি বিশ্ব বিনির্মাণে জ্ঞানচর্চার কোনো বিকল্প নেই। বই পাঠের, শিক্ষা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। আর পাঠক নিয়ে বলতে গেলে, এখনকার পাঠকের বেশিরভাগই ডিভাইসনির্ভর। এটাও ঠিক যে, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় তথ্যপ্রযুক্তির ভেতর দিয়েই আমাদের চলতে হবে। আমার মনে হয়, এখন পাঠকের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। আবার প্রতি বছর জনসংখ্যাও বাড়ছে। বইও বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে দেখেছি, ট্রেনের মধ্যে, বাসের মধ্যে গন্তব্যে যেতে যেতে মানুষ বই পড়ছেন। ভিড়ের মধ্যে ঠাসাঠাসি অবস্থায় থেকেও বই পড়ছেন। আমাদের দেশে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। আমাদের বইমেলা শুধু সাহিত্যের বই বিক্রির মেলা নয়- গল্প, কবিতা, উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ধর্মের বইও বিক্রি হয়। বহু বিষয় ও বৈচিত্র্যময় বইয়ে আমাদের মেলা সমৃদ্ধ। এ মেলাকে আমাদের বৈশ্বিক মিলনমেলায় পরিণত করতে হবে। প্রয়োজনে অনেক বিদেশি বই, প্রয়োজনীয় বই, বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করতে হবে। এ মেলা যেন হয়ে ওঠে বৈশ্বিক জ্ঞানের আঙিনা।
যাযাদি: ভাষার মাস এলেই ভাষা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। আপনার পর্যবেক্ষণ কি? আপনি কি ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন?
এম মিরাজ হোসেন: বাঙালি জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, এটা বিশ্বের ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা। এটা ঠিক যে, আমাদের দেশের বহু জনগোষ্ঠীর ভাষার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে চলে যাচ্ছে। ভাষা প্রবহমান নদীর মতো, এটা ঠিক। ভাষা বদলাবে এটাও ঠিক। কিন্তু ভাষার মর্যাদা রক্ষার তেমন কোনো উদ্যোগ আমাদের দেশে নেই। বাংলা একাডেমি আছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আছে; এদের আসলে কাজটা কি? ভাষা নিয়ে গবেষণা নাকি বই প্রকাশ করে দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করা- আমার বোধগম্য নয়। হঁ্যা, একটা ভাষানীতি থাকলে এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা যেত বলেই আমি মনে করি। শিল্পবিপস্নবের সূচনালগ্নে যেসব জাতি জ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, তারা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারতও শিক্ষার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আমাদের তাদের প্রদর্শিত পথ এবং তাদের উদাহরণ মনে রেখে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
যাযাদি: পাঠকের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
এম মিরাজ হোসেন: বইমেলা জাতি গঠনের মেলা এবং ব্যক্তিকে বিকশিত ও আলোকিত মানুষরূপে গড়ে তোলার মেলা। ফলে, পাঠকদের বলতে চাই, পাঠের কোনো বিকল্প নেই। বই-ই সবচেয়ে বড় বন্ধু। বই পড়ুন, নিজেকে জানুন, নিজেকে আলোকিত করুন। জ্ঞানচর্চা মানুষকে বিকশিত করে। বই পড়ে আমরা আত্মমূল্যায়ন করতে পারি। সমাজের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে, পৃথিবীর কল্যাণে কী কী করণীয়; তা আমরা জ্ঞানচর্চা থেকেই শিখি। সুতরাং, আপনি আলোকিত মানুষ হলে সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে।
যাযাদি: যায়যায়দিনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এম মিরাজ হোসেন: আমার পাঠক এবং আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। শুভকামনা সবার জন্য।
সুত্রঃ যায়যায়দিন